★ আপনার বাগানে হলে, বাঁচিয়ে রাখুন, ফেলে দেবেন না –
★ ঘেঁটু-ঘন্টাকর্ণ-ভাট ★
আজ বলবো, এই সময়ে আমাদের আশেপাশে অপূর্ব ফুলসম্ভার ও সুগন্ধে বাতাস মদির করে তোলা, ঘেঁটু বা ভাটগাছের লৌকিকত্ব ও তার অসামান্য ঔষধিগুণ নিয়ে।
সযত্নে সংরক্ষণ তথা রক্ষা করার প্রয়োজনে এহেন "অমূল্য আগাছা" ঘেঁটু অন্যান্য ঔষধি গাছের মতোই গ্ৰাম্যজীবনে লৌকিক দেবতা হিসাবে পূজিত হয়। পৌরাণিক কাহিনীর মোড়কেও বিশেষভাবে উল্লেখিত করা হয়েছে গাছটিকে। প্রসংগত, আজই "ঘেঁটু" পুজোর দিন।
ফাল্গুন সংক্রান্তিতে হয় ঘেঁটুপূজা। গ্ৰামের কচি-কাঁচারা দলবদ্ধভাবে ঘেঁটুফুল দিয়ে ঘেঁটুর পালকি সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে, "ঘেঁটু-গান" শোনায়। বিনিময়ে চাল আলু পয়সা আদায় করে। তারপর একটা সুবিধামতো দিন দেখে হয় তাদের সম্মিলিত আনন্দের "ফিষ্টি"।
আকন্দ ঘেঁটু ও ধুতরো এই তিনটিই শিবঠাকুরের পরম প্রিয় ফুল। এখন, পুরাণ-অনুসারে এই ঘেঁটু বা ঘন্টাকর্ণ'র সঙ্গে শিবের কী সম্পর্ক, সংক্ষেপে বলি সেই লৌকিক গল্প।
লৌকিক দেবতা ঘন্টাকর্ণ ছিল শিবভক্ত এক পিশাচ বা রাক্ষস। কিন্তু সে এতটাই বিষ্ণুবিদ্বেষী ছিল যে বিষ্ণুর নাম যাতে তার কানে না ঢোকে, সেজন্য সে দুকানে দুটো ভারি ঘন্টা বেঁধে রাখতো। তাই তার এই অদ্ভুত নাম, ঘন্টাকর্ণ। তো, পিশাচজন্ম থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে মহাদেবের কাছে কাকুতি-মিনতি করলে, মহাদেব তাকে উল্টে নারায়ণেরই স্তব-স্তুতি করতে পরামর্শ দিলেন। শিবের পরামর্শ মাথা পেতে নেয় ঘণ্টাকর্ণ।
বহুদিন পরে নারায়ণ কৈলাশে মহাদেবের সাথে দেখা করতে আসার পথে, বদ্রীকাশ্রমে তাঁকেই ব্যাকুলভাবে আরাধনারত ঘণ্টাকর্ণকে দেখতে পান। তৃপ্ত, সন্তুষ্ট নারায়ণ তখনই ঘণ্টাকর্ণকে পিশাচ-দশা থেকে মুক্তি দেন।
অযত্নসঞ্জাত এই ঘেঁটু, ঘণ্টাকর্ণ, ভাট, বনযুঁই, পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের এক অতি পরিচিত ভেষজ গুল্ম। হিন্দিতে এর নাম - ভাঁট, টিনাভার্মি, সাঁওতালিতে - খারবারি।
বৈজ্ঞানিক নামঃ Clerodendrum viscosum Vent., Syn. C. infortunatum autc. non. L.
রাস্তার ধারে বা জঙ্গলের কিনারায় ৪-৫ ফুট উচ্চতার এই গুল্মজাতীয় ঝোপাকৃতি গাছটি জন্মায়। পাতা ৪-৮ ইঞ্চি লম্বা হৃৎপিন্ডাকার, ডগার দিক ক্রমশঃ সরু। শীতের শেষদিকে ফুল ফোটে। পূষ্পদন্ড ৮-১২ ইঞ্চি লম্বা ও বহু শাখায় বিভক্ত। বৃতি লাল, ফুলের পাপড়ি ঈষৎ লাল আভাযুক্ত সাদা। ফল সামান্য চ্যাপ্টা গোলাকৃতি, পাকলে ঘোর কালো। ফুল ফোটা অবস্থায় সুগন্ধে ম ম করে চারিদিকের বাতাস, দেখতেও অত্যন্ত নয়নাভিরাম।
পাতা মূল ফুলসহ সমগ্ৰ উদ্ভিদই অসামান্য ভেষজ গুণসম্পন্ন।
সংক্ষেপে এটি রক্তশোধক, বলকারক, হজমশক্তি বৃদ্ধিকারক, কৃমি ও চর্মরোগনাশক, রজঃরোধক, কম্পজ্বর, সর্দি কাশি, গেঁটেবাত, গলরোগ ও টিউমারে কার্যকরি।
ব্যবহারবিধিঃ
বসন্তশেষে (মার্চ-এপ্রিলে) সমগ্ৰ গাছ ছোটো ছোটো কুঁচো করে কেটে ছায়ায় শুকনো করে নিয়ে বায়ুনিরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়।
এই শুকনো গাছ ৬-৮ গ্ৰাম, ১৫০ মিলিঃ জলে ফুটিয়ে, মেরে নিয়ে ১০০ মিলিঃ করে, ছেঁকে সকাল - বিকাল খালিপেটে খেতে হবে ১০-১৫ দিন। এটি বলশক্তি ও বীর্যবর্দ্ধক এবং রক্তশোধক। শ্বেতী বা লিউকোডার্মায় এই পদ্ধতিতে এটি দীর্ঘদিন ব্যবহারে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
সামান্য নুন মিশিয়ে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় এই ক্কাথটি (Decoction) দিয়ে গড়গড়া করলে টনসিলাইটিস ও ফ্যারিঞ্জাইটিস প্রশমিত হয়। রজঃ বা মেনস্ট্রুয়েশন পিছিয়ে দেবার জন্যও এটি, টানা বেশ কিছুদিন সকালে খালিপেটে খেতে হয়।
চর্মরোগে – ঘেঁটুপাতার রস নিয়মিত লাগালে খোস চুলকানি ও গর্মিফোঁড়া দিন সাতেকের মধ্যেই কমে যাবে। ঘেঁটুপাতার রস ৩০ মিলিঃ ও নিশিন্দাপাতার রস ১০ মিলিঃ খাঁটি নারকেল তেল ১২০ মিলিঃ একত্রে মিশিয়ে লোহা বা স্টীলের পাত্রে ফেনা সম্পূর্ণ মরে যাওয়া পর্যন্ত ফুটিয়ে নিন। তেল ঠান্ডা হয়ে গেলে মিহি কাপড়ে ছেঁকে বায়ুনিরোধক কাচের শিশিতে ভরে রাখুন। নিশিন্দাপাতা না পেলে পরিবর্তে তুলসী পাতার রসও দিতে পারেন। একজিমা ও সোরাইসিসের মত দুরারোগ্য চর্মরোগেও এই তেলটি খুবই উপকারী।
ম্যালেরিয়া জাতীয় কাঁপুনি সহ জ্বরে পাতার রস ৫-৬ মিলিঃ আধকাপ ঈষদুষ্ণ জলে মিশিয়ে সকালে - বিকালে ৭-১০ দিন নিয়মিত খেলেই অসুখটা সেরে যাবে।
কুঁচো-কৃমির উপদ্রব কমাতে পাতার টাটকা রস সকালে খালিপেটে বয়স অনুযায়ী ২-৬ মিলিঃ পরিমান ৫-৭ দিন খেতে হবে। বড় কেঁচো-কৃমির ক্ষেত্রে এই রসের সঙ্গে ৩-৪ টি বিড়ঙ্গ (Embelia ribs) বীজচূর্ণ মিশিয়ে নিতে হবে।
চুলের উকুন সহ গায়ের চামাটি উকুনেও, স্নানের অন্তত আধঘন্টা আগে ঘেঁটুপাতার রস পরপর দু-তিনদিন ছাড়া কয়েকবার নিয়মিত মাখলেই উকুনের হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে। ইচ্ছে করলে এই রসের সঙ্গে যৎসামান্য কর্পূর মিশিয়ে নিতে পারেন।
কাঁকড়া-তেঁতুলে বিছের কামড়েও ঘেঁটুপাতার রস লাগালে সামান্য সময়ের মধ্যেই ব্যথা যন্ত্রনা ও ফোলা কমে যাবে।
ঘেঁটুর মূল মিহি করে বেটে টিউমারে নিয়মিত লাগালে টিউমার আস্তে আস্তে নরম হয়ে বসে যাবে।
গেঁটে বাতে ঘেঁটুর টাটকা মূল ৮-১০ গ্ৰাম, দ্বিগুণ পরিমান পিঁয়াজসহ একত্রে শিলে বেটে, আক্রান্ত অংশে প্রতিদিন প্রলেপ দিলে ১০-১২ দিনেই বাতের ফোলা ও ব্যথা কমে যাবে।
হজমশক্তি কমে গিয়ে অজীর্ণ, ভসকা পায়খানার সাথে মাঝে মাঝেই বেশ পেট ব্যথা হচ্ছে। এই অবস্থায় ঘেঁটুমূলের ছাল ৪-৫ গ্ৰাম, টাটকা ঘোলের সঙ্গে বেটে সকালে খালিপেটে ৭-১০ দিন খেলেই সব উপসর্গ সেরে যাবে। সঙ্গে অবশ্যই লঘুপাক আহার খেতে হবে।
অনুরোধ, ঘেঁটুর অন্য কোনো আঞ্চলিক নাম ও লৌকিক ব্যবহার জানা থাকলে, মন্তব্যের ঘরে জানান। সমৃদ্ধ হোক এই সামান্য প্রতিবেদন।
Md Saddam
Eliminar comentario
¿ Seguro que deseas eliminar esté comentario ?
Mdmintu Molla
Eliminar comentario
¿ Seguro que deseas eliminar esté comentario ?